শাখা সমূহ

নিল এলডেন আর্মস্ট্রং: চাঁদের বুকে মানুষের পায়ের ছাপ, হার না-মানা এক বীর

নিল এলডেন আর্মস্ট্রং শুধু একটি নাম নয়; তিনি হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রকৃত নায়ক। তিনি ছিলেন একজন নৌ-বিমানচালক, পরীক্ষামূলক পাইলট একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি চন্দ্রপৃষ্ঠে পা রাখা পৃথিবীর প্রথম মানব।

দিনটি ছিলো ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে অজানা পথে দুঃসাহসী এক অভিযানে নেমে পড়েছিলেন নিল আর্মস্ট্রং। তার সাথেই ছিলেন এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স। অ্যাপোলো-১১ মহাকাশযানে চরে অভিযানটির সূচনা হয়। তিনি ছিলেন এই অভিযানের কমান্ডার।

চার দিনের দুঃসাহসিক যাত্রা শেষে ২০ জুলাই যে ক্ষণটিতে চাঁদের বুকে পা রাখলেন নীল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অলড্রিন। আরেক নভোচারী মাইকেল কলিন্স থেকে যান মূল মহাকাশ যান অ্যাপোলো-১১ এ। পৃথিবীর ৫০ কোটি মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় সে মুহূর্তের দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। চাঁদের মাটিতে পা রেখে আর্মস্ট্রং বলেছিলেন,

That’s one small step for man, one giant leap for mankind. (এটা মানুষের জন্য ছোট পদক্ষেপ, তবে মানবজাতির জন্য মহান এক অগ্রগতি)

আর্মস্ট্রংদের এই অবিশ্বাস্য সফলতা মানবজাতিকে নতুন করে উড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বপ্নের আকাশে।

তাদের এই চান্দ্রাভিযান এতটা সহজ ছিলো না। প্রথম চারদিন সবকিছু ঠিক থাকলেও চাঁদের বুকে পা রাখার ২০ মিনিট পূর্বে সমস্যা এসে উপস্থিত। এ যেন তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার উপক্রম। একদিকে পৃথিবী থেকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে রেডিও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্যদিকে, নিল আর্মস্ট্রং লুনার মডিউল ইগলের গতিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না।

মূলত বিষয়টি হলো- চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন অ্যাপোলো–১১ মহাকাশযানের লুনার মডিউল ইগলে চেপে রওনা হন। চাঁদে অবতরণের ২০ মিনিট আগে হঠাৎ করেই যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনে নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ইগলের। এমন মুহূর্তে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়ায় অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বুঝতে পারে যে, ইগলের কম্পিউটার–ব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। কম্পিউটারটি ঠিক সময়ে কমান্ড নিচ্ছিলো না।

এদিকে নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় ইগলের গতিও কমাতে পারছিলেন না আর্মস্ট্রং। ফলে চন্দ্র পৃষ্ঠের যে স্থানে তাঁদের অবতরণের কথা, সেখান থেকে কয়েক মাইল দূরে ছিটকে পড়ার উপক্রম। এমতাবস্থায় বাধ্য হয়েই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বন্ধ করে ইগলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেন কমান্ডার আর্মস্ট্রং। এরপর অবতরণের নতুন জায়গা খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু চাঁদের পাথুরে পৃষ্ঠে তেমন কোনো জায়গাও পাচ্ছিলেন না। এদিকে ইগলের জ্বালানিও ফুরিয়ে আসছিল। আর মাত্র ৪০ সেকেন্ডের জালানী বাকি ছিলো।

এরকম কঠিন পরিস্থিতিতেও মাথা ঠান্ডার রেখে নিজের কাজ করে যান আর্মস্ট্রং। হঠাৎ করেই অলড্রিন চেঁচিয়ে বলে উঠলো কন্ট্যাক্ট লাইট। শব্দ শুনেই প্রায় স্তব্ধ হয়ে যান আর্মস্ট্রং। আসলে এর অর্থ হলো- চাঁদের বুকে অবতরণ করেছে লুনার মডিউল ইগল।
পরক্ষণেই হিউস্টনে নিয়ন্ত্রণকক্ষে বার্তা পাঠান আর্মস্ট্রং। নিয়ন্ত্রণকক্ষে তখন খুশির জোয়ার। ফিরতি বার্তায় নিয়ন্ত্রণকক্ষের চার্লস ডিউক বলেন,

আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ধন্যবাদ তোমাদের, আমরা আবারও শ্বাস নিতে পারছি।

১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। পৃথিবীর ইতিহাসের এক অনন্য দিন। অকুতোভয় তিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন ও মাইকেল কলিন্স মানব জাতির পক্ষে প্রথম চন্দ্র জয় করেছিলেন। নিজের পায়ের ছাঁপ রেখে এসেছিলেন চাঁদের বুকে। চন্দ্রজয়ের নায়কদের মধ্যে সবার আগে যে নামটি চলে আসে, সেই নিল আর্মস্ট্রং।

১৯৩০ সালের ৫ই আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াপাকোনেটা, ওহাইও-তে জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রজয়ী বীর নিল আর্মস্ট্রং। তিনি ছিলেন ভিওলা লাউসি ও স্টিফেন কনিগ আর্মস্ট্রং এর ছেলে। তার পিতা ওহাইও সরকারের একজন নিরীক্ষক।

ছয় বছর বয়সে বাবার সঙ্গে তিনি বিমানে চড়েন। তখন থেকেই আকাশে ওড়ার প্রতি তাঁর অনুরাগ জন্মে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারডিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈমানিক প্রকৌশল বিভাগে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন এবং এডোয়ার্ডস এয়ার ফোর্স বেইজ, ক্যালিফোর্নিয়ায় -তে পরীক্ষামূলক বৈমানিক হন। নিল আর্মস্ট্রং ১৯৬২ সালে মহাকাশচারী কর্পসে’ হিসেবে নাসায় যোগদান করেন। এবং জেমিনি-৮ মহাকাশ যানের ‘কমান্ড পাইলট’ হিসেবে প্রথম মহাকাশ যাত্রা করেন। এই মিশনে তিনি প্রথমবারের মতো ডেভিড স্কটের সঙ্গে যৌথভাবে স্পেসক্রাফট ডকিং করতে সক্ষম হন। এটি ছিলো মূলত মহাশূন্যে দু’টি মহাকাশযানকে মিলিত করার একটি প্রক্রিয়া। তবে নিল আর্মস্ট্রং বিপদজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে মিশনটি বাতিল করা হয়েছিলো।

পঞ্চাশের দশকে কোরিয়া যুদ্ধের সময় তিনি নেভির যুদ্ধবিমান চালাতেন। ১৯৬২ সালে তিনি মার্কিন মহাকাশ কর্মসূচিতে যোগ দেন। অ্যাপোলো-১১ ছিল আর্মস্ট্রংয়ের শেষ মহাকাশ অভিযান। ১৯৭১ সালে তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) ছেড়ে যান। পরে তিনি অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং (বিমান ও নভোযান প্রকৌশল) বিষয়ে পড়াতেন। নিভৃতচারী এই মানুষটি ছিলেন খুবই আশাবাদী।

২০১২ সালের ২৫ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন আমেরিকার এই মহাবীর। আর্মস্ট্রংয়ের মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। এক বিবৃতিতে ওবামা বলেছেন,

শুধু তাঁর সময়ই নয়, সর্বকালের সব আমেরিকান বীরদের মধ্যে নিল সর্বশ্রেষ্ঠ। অজানাকে জানার জন্য আজ যাঁরা নিবেদিত, তাঁদের সবার মধ্যে নিলের আবিষ্কারের নেশা ছড়িয়ে আছে। তাঁর অবদান চির অম্লান থাকবে, যিনি আমাদের একটি ছোট্ট পদক্ষেপের মধ্যে নিহিত বিপুল ক্ষমতার কথা জানিয়ে গেছেন।

নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিনের চাদে অবতরণ। ছবি: নাসা

ঢাকায় তিন নভোচারী

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পার্লামেন্ট থেকে জানান যুক্তরাষ্ট্রের এই বিজয়ের আনন্দ সমগ্র পৃথিবীর সাথে ভাগাভাগি করা হবে। মহাকাশ অভিযান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও ও অভিজ্ঞতা জানানোর সে লক্ষ্যে ২৩টি দেশের মোট ২৭টি শহর ভ্রমণের পরিকল্পনা তারা করেন।

তালিকায় থাকা ২৩টি দেশের মধ্যে পাকিস্তান ও তালিকায় থাকা ২৭টি শহরের মধ্যে ঢাকাও ছিলো অন্যতম একটি। বিশ্বভ্রমণের পরিকল্পনা অনুসারে তাদের ঢাকায় আসার তারিখ নির্ধারিত হয় ২৭ অক্টোবর। এ খবর অতিদ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের আগমনের সংবাদ শুনে উল্লাসিত হয় বাংলার মানুষ।

২ অক্টোবর ১৯৬৯ সালে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় তাদের আগমনের সংবাদ প্রকাশিত হয় বেশ ঘটা করে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়-

চন্দ্রবিজয়ীদের যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে সংবর্ধনা জানানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় এক ব্যাপক প্রস্তুতিপর্ব চলছে। এপোলো ১১ এর তিনজন নভোচারী আগামী ২৭ অক্টোবর এখানে আগমন করবেন।

নভোচারী নেইল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন মাইক্যাল কলিন্স্ একটি মোটর গাড়ি করে ঢাকার রাজপথ অতিক্রম করবেন। এতে অধিক সংখ্যক লোক তাদের দেখতে সম্বর্ধনা জানাতে সুযোগ পাবে।

প্রাদেশিক চীফ সেক্রেটারী অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যরা বিমানবন্দরে নভোচারী তাদের স্ত্রীদের অভ্যর্থনা জানাবেন। তারা ঢাকায় মাত্র একদিন অবস্থান করবেন এবং সেই দিনই প্রাদেশিক গভর্নর প্রদত্ত এক সম্বর্ধনায় যোগ দেবেন। চন্দ্রবীররা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করবেন।

তাদের দেখার উদ্দেশ্যে স্কুলের ছেলেমেয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। চন্দ্রবীররা পরের দিন ঢাকা ত্যাগ করবেন।

চন্দ্রবিজয়ী বীরদের আগমন নিয়ে দেশের লোকজন এবং পত্র-পত্রিকা এতই উচ্ছ্বসিত ছিল যে পুরো ঢাকা শহরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত করার আমেজ পড়ে যায়। এ উপলক্ষে শহর পরিষ্কার করার বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয় পত্রিকায়।

২১ অক্টোবরে দৈনিক পূর্বদেশ-এ প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিটি ছিলো এরকম-

চন্দ্রলোক থেকে ফেরা তিন জন মার্কিন মহাশূন্যচারী বিশ্ব সফরে আগামী ২৭শে অক্টোবর ঢাকায় আসছেন। আর এই উপলক্ষে শহরের রাজপথগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে করে তোলা শুরু হয়েছে। কোথাও রাস্তার আইল্যান্ডগুলোর পাকা সীমানাগুলোয় চুন দেয়া হচ্ছে, কোথাও ভাঙাচোরা জায়গাগুলো সিমেন্ট বালি দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে, আবার কোথাও ফুটপাতের উপর থেকে ময়লা আগাছা লতাগুল্ম ঘাসপাতা পরিষ্কার করা হচ্ছে এবং কোথাও কোথাও রাস্তার পাশের নোংরা দেয়ালগুলো ঘষেমেজে পরিষ্কার করা হচ্ছে, চুনকাম করে ঝকঝকে করে তোলা হচ্ছে। ঢাকা শহরের নতুন পুরাতন এলাকার রাস্তাঘাটে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা এমনিতে বড় দেখা যায় না।

ঢাকার রাস্তায় তিন চন্দ্রজয়ী। ছবি: সংগৃহীত

সময়সূচী অনুসারে ২৭ তারিখ ঢাকায় আসেন চন্দ্রবিজয়ী ও তাদের সহধর্মিণীরা। তাদের দেখতে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে বিমানবন্দরে এবং তার আশেপাশে রাস্তার দু’ধারে। লোক সমাগম এতই বেশি ছিল যে পুলিশের বেষ্টনী ভেঙ্গে লোকজন বিমানের সিঁড়ির দিকে ছুটে চলে যায়। পুলিশের পক্ষে জনতার চাপ নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর ছিল। একসময় লোকজনকে কোনোক্রমে সরিয়ে তাদেরকে বিমান থেকে বেরিয়ে আসতে রাস্তা করে দেয় পুলিশ।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টে আর্মস্ট্রং, অলড্রিন ও কলিন্স। ছবি: সাইদা খানম

তাদেরকে পৌঁছে দিয়েছিল । হতো। তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণের পর শহরের অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে দেখানো হয়। তাদের গাড়ির ছাঁদ ছিল খোলা। ফলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দূর থেকেই জনতা তাদের দেখতে পেয়েছিল। কয়েক মাইল ভ্রমণের পর তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। সেখানে তাদেরকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। যতক্ষণ তারা ঢাকায় অবস্থান করেছেন ততক্ষণ তাদেরকে দেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের আনা-নেয়ার কাজে এটি ব্যবহৃত হওয়া সুরক্ষিত বিমান ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’ তাদের যাতায়তের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো।

Comments

    Report

    Please Select a problem
    If someone is in immediate danger, get help before reporting to us. Don't wait.