শাখা সমূহ

শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ একই সুতোয় গাঁথা

মার্চ ১৭, ১৯২০ দিনটি ছিল ঝলমলে আলোকিত। চৈত্রের তৃতীয় দিনে নীল শুভ্র আকাশ সেজেছিলো অপরূপ সাজে। সেদিন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মাহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তার নামের আগে শেখ শব্দটি ব্যবহার হচ্ছে মূলত বংশগত পদবি হিসাবে। শেখ বোরহান উদ্দিন (রহ:) ছিলেন প্রাচীন শ্রীহট্ট (আধুনা সিলেট) অঞ্চলে বসবাসকারী একজন নাগরিক, যিনি দ্বাদশ শতাব্দিতে দেশের প্রথম সারির মুসলিম বা ধার্মিকদের একজন। শেখ বোরহান উদ্দিন ছেলের জন্ম উত্সব উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধি সাব্যস্ত হন। ফলে গোবিন্দ বোরহান উদ্দিনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হ্ত্যা করে। সেই মহামানব শেখ বোরহান উদ্দিনের বংশেই জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গালি জাতির আরেক মহামানব শেখ মুজিবুর রহমান।

 

বাল্যকালে দুরন্তপনা দুষ্ট ছেলেটি খেলাধুলায় ছিলো পারদর্শী, গলারস্বরও ছিল সুন্দর ফলে গানেও সংগীতে তার দক্ষতা ছিল অসাধারণ। কিন্তু ভাগ্য তাকে সহায় দেয়নি। সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় হঠাৎ আক্রান্ত হন বেরিবেরি রোগে। চলে যান কলকাতায়। দুই বৎসর চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ্য হলেও অসুস্থ্যতা ছেড়ে যায় নি। ১৬ বছর বয়সে পুনরায় আক্রান্ত হন গ্লুকোমা নামক চক্ষু রোগে। ফলে পুনরায় চলে যান কলকাতায়। কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই চক্ষুই অপারেশন করানো হয়। আল্লাহর অশেষ রহমতে সুস্থ্য হয়ে যান তিনি। তবে বিখ্যাত সেই চশমার ব্যবহার শুরু হয়।

১৯৩৬ সাল ইংরেজদের বিরুদ্ধে তখন স্বদেশি আন্দোলন চলতে থাকে। কোন কাজ ও পড়াশুনা না থাকায় শেখ মুজিবের একটা কাজ সভায় যাওয়া। রোজ সভায় যাওয়ার ফলে সভার নেতৃবিন্দুদের নজরে আসলেন তিনি। সেই থেকে শুরু রাজনৈতিক জীবনে পদাচরণা। আন্দোলনের কাজে প্রায়ই গোপালগঞ্জ ও মাদারিপুরে যেতে হতো তাকে।

১৯৩৮ সাল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও শ্রম মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জে আসবেন। এগজিবিশন হবে তাই চলছে আয়োজন। বিষয়টি নিয়ে মুসলিম ছাত্র ও জনতার মাঝে ব্যপক আলোড়ন সৃষ্টি হল। বঙ্গবন্ধু তখন গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের ছাত্র। স্কুল ছাত্র অসুস্থ্যতার কারণে পিছিয়ে পড়ায় বয়সটা ছিল বেশি। তাই সেচ্ছাসেবক দল গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হল তাকে। ফলে এগজিবিশন উদ্বোধন শেষে শেরে বাংলা গেলেন পাবলিক হল পরিদর্শনে আর সোহরাওয়ার্দী গেলে মিশন স্কুল পরিদর্শনে। এসময় বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দীর খুব কাছেই ছিলেন। তিনি কিছু প্রশ্ন করলে বঙ্গবন্ধু তার জবাব দিলেন এবং একটা কাগজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ও ঠিকানা রেখে দিলেন। এ থেকেই রাজনৈতিক জীবনে পা দেওয়া শুরু।

শুরু হলো সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে পত্রবিনিময়। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় গিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে দেখা করলেন বঙ্গবন্ধু এবং তাকে গোপালগঞ্জে আসার অনুরোধ করেন কেননা বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা হল গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠন করা। এবং ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠন হল, খন্দকার শাসসুদ্দীন হলেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু হলেন সম্পদক এবং এসময় বঙ্গবন্ধুকে মুসলিম লীগের ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি করা হল। এসময় তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতে যোগদান করেন।

১৯৪১ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু ভীষণভাবে জ্বরে আক্রান্ত হলে ফল বিপর্যয় ঘটে। ফলে পুরুদমে রাজনীতি করা শুরু করেন তিনি। এসময় বঙ্গবন্ধু চলে যান কলকাতায়, কাজ বলতে শুধু একটাই সভা-সমাবেশ করা। একসময়ের দুরন্তপনা ছেলেটি এখন ছেড়ে দিয়েছে খেলাধুলা। মুসলমানদের মুক্তির দাবিতে পাকিস্তান গড়ার আন্দোলনে নাম লিখালেন তিনি। যথাসম্বব ১৯৪১ সালেই বঙ্গবন্ধূ ফরিদপুর ছাত্রলীগ জেলা কনফারেন্স করে শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রন জানান, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ূন কবির, ইব্রাহিম খাঁ’র মত কবি সাহিত্যিকের আগমণ ঘটেছিল সেদিন। কিন্তু ইংরেজ সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে কনফারেন্স বন্ধ করে দেয়। তখনই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন তার রাজনীতি জাতীয় পর্যায়ে চলে গেছে।

১৯৪২ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলায় আসলে সম্মেলনে যোগদান করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মাহকুমা থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে সিরাজগঞ্জ মাহকুমায় যান। এসময় প্রায় সকল জাতীয় নেতাদের সঙ্গে তার সাক্ষাত হয়।

১৯৪৩ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মুসলিম লীগ কাউন্সিলরের সদস্য হন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলমান ছিল বিধায় ইংরেজরা সমস্ত নৌকা ও ইনঞ্জিন চালিত নৌ-যান বাজেয়াপ্ত করে। ধান, চাল, আটা সৈন্যদের খাবারের জন্য গুদাম জব্দ করে রাখে। ফলে ১০ টাকা মনের চাউল ৪০-৫০ টাকা মনে বিক্রি হয়। এসময় সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে বিভিন্ন জায়গায় লঙ্গরখানা নির্মাণ শুরু হয়। ইংরেজরা ট্রেনে অস্ত্র নিয়ে জায়গা থাকলে রিলিফ নিতো নয়তো না। বাঙ্গালী জাতি যে অনাহারে মরছে এ নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমান ও ছাত্রলীগ এবং মুসলীম লীগের সদস্যরা এসময় কলকাতা ও বাংলায় ত্রাণ বিতরণে নিজেদের আত্মনিয়োগ করে। এভাবেই তারা মুসলিম লীগকে জনগনের দল হিসাবে গড়ে তুলে।

এভাবেই চলতে লাগলো দিন গুলো এরপর থেকে ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগই হলো বঙ্গবন্ধুর প্রাণ। রাজনীতি মিশে গেল রক্তে। দেশ ও দেশের জনগনকে অত্যাচার ও শোষণ মুক্ত করার জন্য কাজ করতে থাকলেন। ওনার কর্মস্পৃহার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৪৪ সালে সোহরাওয়ার্দী যখন বলেছিলেন “Who are you? You are nobody!” তখন বঙ্গবন্ধু ওনাকেও ছাড় দেন নাই সাথে সাথে জবাব দিয়ে বসলেন “If I’m no bobody, then why you have invited me? You have no right to insult me. I will prove that I’m somebody. Thank you sir. I will never come to you again.” শেখ মুজিব সেদিনই অন্তর থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি প্রমাণ করবেন তিনি কিছু কেউ একজন। তখনো জাতি জানতো না আসলেই তিনি কে???

১৯৪৫-৪৭ সময়ে মুসলিম লীগে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। একপর্যায়ে মুসলিম লীগ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। খাজা সাহের পক্ষে এক দল অপর দল সোহরাওয়ার্দী সাহেবের পক্ষে। কিন্তু ১৯৪৬ সালে ক্যাবিনেট মিশন হলে মুসলিম লীগ ও ছাত্রলীগ এক হয়ে আন্দোলন শুরু করে। পাকিস্তান গঠন করতেই হবে। হিন্দু কংগ্রেসের সাথে থেকে অখন্ড ভারত গঠন করা সম্ভব না। তাই বঙ্গবন্ধুও এই আন্দোলনে মনেপ্রাণে নেমে গেলে। ১৯৪৬ সালে আগস্ট মাস ব্যপী আন্দোলন চলতে থাকে। ১৫ই আগস্ট ঠিক করে দেওয়া হয় কে কোথায় কি করবে এবং ১৬ই আগস্ট থেকে শুরু হয় আন্দোলন।

১৯৪৭ সালের জুন মাসে ভারতবর্ষ ভাগ করার ঘোষণা শুরু হল। কংগ্রেস ভারত ভাগে রাজি ছিল না প্রথমে অন্যদিকে অখন্ড বাংলা আন্দোলন ব্যর্থ হলে কংগ্রেস রাজি হয়। কেননা, এতে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এসময় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর সদস্য থাকেন। দেশ ভাগ আমরা চলে যাই পূর্ব-পাকিস্তান হিসাবে পাকিস্তানের অংশে। এবার শুরু পাক শোষনের পালা।

১৯৪৮ সালে প্রথমে রাষ্ট্র ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। জিন্নাহ চেয়েছিল একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। কিন্তু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল বাঙ্গালি তথা বাংলা ভাষাভাসি। এতদ্বসত্বেও যখন তারা রাজি হলো না তখনই শুরু হলো রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিলেন। ১১ই মার্চ কে করা হলো ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস। আন্দোলন চলতে থাকে সেই সাথে চলতে থাকে পাকিস্তানি নির্যাতন। বঙ্গবন্ধুও নুয়ে পড়ার লোক নয়। পুলিশী কার্যক্রমের প্রতিবাদে শেখ মুজিব ১৭ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন। ১৯ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি আন্দোলন পরিচালনা করেন। সভা সমাবেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে ছাত্র সমাজ ও জনতাকে সমসময় জাগ্রত রাখতেন দাবি আদায়ে। পরে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ তারিখে তাকে আবার আটক করা হয় এবং বহিষ্কৃত হন। ১৯৪৮ সালের ১১ই নভেম্বর জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করলে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন খাজা নিজামউদ্দিন। সকলে আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন কিন্তু কে জানত আশার আলোর নিচেই রয়েছে নিকোশ অন্ধকার!!!

পরিবারের সাথে বঙ্গবন্ধু

১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবার চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবী আদায়ের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এ জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জরিমানা করা হয় কিন্তু তিনি জরিমানাকে অবৈধ ঘোষণা করে তা আদায় থেকে বিরত থাকে এবং সেই আন্দোলনের সফলতার জন্য উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশনের ধর্মঘট করেন। এসময়ই তাকে আটক করা হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ছাত্রদের গ্রেফতার এর প্রতিবাদে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালনের ঘোষণা হয়। এটি ছিলো প্রথম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের প্রতিবাদ।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের পূর্ব পাকিস্তান আগমনকে উপলক্ষ করে আওয়ামী মুসলিম লীগ ঢাকায় দুর্ভিক্ষবিরোধী মিছিল বের করে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে শেখ মুজিব পুনরায় আটক হন। এসময় বঙ্গবন্ধুর দুই বছর জেল হয়েছিল। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এ ঘোষণার পর জেলে থেকে নির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে পরিচালনায় তিনি ভূমিকা রাখেন। একই সময়ে বঙ্গবন্ধু জেলে থাকা অবস্থায় ১৪ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন পালনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৩ দিন অনশন কার্যকর থাকলে পাক প্রশাসন ২৬শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ তারিখে তাকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের শেষে দলের সেক্রেটারী জেনারেল নির্বাচিত হন। এবছর ১৪ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অন্যান্য দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মধ্যে ২২৩ টিতে বিপুল ব্যবধানে বিজয় অর্জন করে যার মধ্যে ১৪৩ টি আসনই আওয়ামী লীগ লাভ করেছিল। শেখ মুজিব গোপালগঞ্জে আসনে ১৩,০০০ ভোটের ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন। এটি ছিলো রাজনৈতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম সর্ব বৃহৎ বিজয়।

১৯৫৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিয়ে একযোগে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ এবং গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দলের জন্য সম্পূর্ণ সময় ব্যয় করার জন্য ১৯৫৭ সালে ৩০ মে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ৭ আগস্ট সরকারি সফরে চীন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন গমন করেন।

১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা এবং সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান দেশে সামরিক আইন জারি করলে সকল ধরণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার কর্মকাণ্ড অব্যহত রাখায় ১১ অক্টোবর আবার গ্রেফতার হন। টানা ১৪ মাস আটক থাকার পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হলেও পুনরায় জেলের ফটক থেকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৬০ সালের ৭ই ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করে বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করে। জেল থেকে বের হন ১৯৬১ সালের জানুয়ারিতে। এসময় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্র নেতৃবৃন্দ দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি মহকুমায় এবং থানায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন।

১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রয়ারি জননিরাপত্তা আইনে তাকে আবার আটক করা হয়েছিল। জুনের ২ তারিখে চার বছরব্যাপী মার্শাল ল অপসারণের পর ১৮ জুন তারিখ তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এসময় ৫ই জুলাই বঙ্গবন্ধু আইয়ূব খান সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। এবং ২৪শে সেপ্টেম্বর সেখানে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে মিলে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলেন।

১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দী অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থান করলে তার সঙ্গে পরামর্শের জন্য লন্ডন যান। ৫ই ডিসেম্বরর সোহরাওয়ার্দী লেবাননের বৈরুতে ইন্তেকাল করেন।

১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মুজিবের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আওয়ামী লীগকে পুণরায় সংহত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সভায় দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি, সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সংক্রান্ত প্রস্তাব গৃহিত হয়। ১১ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এসময় আইয়ুব বিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ গ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৪দিন পূর্বেই আইয়ুব খান প্রশাসন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে।

১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এবং এক বছরের কারাদণ্ড প্রাপ্ত হন। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন।

১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহেরর জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। এই ছয় দফা দাবি বাঙ্গালি জাতির মুক্তির সনদ নামে পরিচিত। ১মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এসময় শেখ মুজিব এই দাবীকে “আমাদের বাঁচার দাবী” শিরোনামে প্রচার করেছিলেন এবং এর বৈধতা অর্জনের জন্য জনমত সৃষ্টিতে কাজ করতে থাকেন ফলে তিনি প্রায় পুরো দেশই ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণের সময় সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকায় বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে বন্দী হন। পরে ৮ই মে নারায়ণগঞ্জের পাট কারখানার শ্রমিকদের এক র‍্যালিতে অংশগ্রহণের জন্য তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব এবং আরও ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে সুপরিচিত মামলাটি দায়ের করে। ফলে দুই বছর কারাবাসের পরে ১৭ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে আটক করে ঢাকা সেনানিবাসে রাখা হয়।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারি ৫ তারিখে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা সহ তাদের এগার দফা দাবী পেশ করে। এই পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গৃহীত হয়। এই সংগ্রাম এক সময় গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। এই গণ আন্দোলনই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নামে পরিচিত। মাসব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ, কারফিউ, পুলিশের গুলিবর্ষণ এবং বেশ কিছু হতাহতের পর আন্দোলন চরম রূপ ধারণ করলে পাকিস্তান সরকার ছাড় দিতে বাধ্য হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের সাথে এক গোলটেবিল বৈঠকের পর এই মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এর সাথে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলকে মুক্তি দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে শেখ মুজিবের সম্মানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক সভার আয়োজন করে। লাখো জনতার এই সম্মেলনে জনাব তোফায়েল আহমেদের ঘোষণা কর্তৃক শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি প্রদান করা হয়। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে “বাংলাদেশ” নামে নামকরণ করেন।

১৯৭০ সালের ৬ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১লা এপ্রিল আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহিত হলে ৭ই জুন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায় ছয় দফার বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামীলীগের পক্ষে জনসমর্থনের আহ্বান জানান। ১৭ই অক্টোবর তার দলের প্রতিক হিসাবে নৌকা পছন্দ করেন। ঢাকার ধুলাইখালের জনসভার মাধ্যমে প্রথম নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন। ৭ই ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কোটার ২ টি আসন ছাড়া বাকি সবগুলোতে জয়ী হওয়ার জন্য জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করে আওয়ামী লীগ।

১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো, মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল বিরোধিতা করেন। ভুট্টো এ্যাসেম্বলি বয়কট করার হুমকি দিয়ে ঘোষণা দেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানালে তিনি সে সরকারকে মেনে নেবেন না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেন। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। সামরিক বাহিনীর অভিযান শুরু হলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারি আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। ৯ই জানুয়ারি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। লন্ডন থেকে ঢাকায় আসার পথে ভারতে যাত্রা বিরতি করেন এবং বিমান বন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। ১০ই জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছেন। ১২ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন। ১০ই অক্টোবর বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী’ পুরস্কারে ভূষিত করেন। ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন ৭ই মার্চ। ১৫ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। ১৪ই ডিসেম্বের বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন। ১৬ই ডিসেম্বর থেকে সংবিধান কার্যকর হয়।

১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩০০ আসনের মাঝে আওয়ামীলীগ ২৯৩ আসন লাভ করে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে। ৬ই সেপ্টেম্বর জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগদানের জন্য আলজেরিয়া গমন করেন ও ১৭ই অক্টোবর জাপান সফর করেন।

১৯৭৪ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি ওআইসি (OIC) সম্মেলনে যোগদানের জন্য পাকিস্তানে গমন করেন। ইতোপূর্বে ২২শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে ও ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষন দেন।

১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে এবং রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করে। ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠন করে। এই বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) গঠন তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাড়ায়। দেশের কিছু মহল বাকশাল ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেন নি। তখন থেকেই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর বিরোদ্ধে ষড়যন্ত্র। তার দলীয় নেতাকর্মীদের কিছু অংশ সহ সেনাবাহিনীর কিছু অংশ ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। একপর্যায়ে ষড়যন্ত্র প্রকট আকার ধারণ করে।

আগস্ট ১৫, ১৯৭৫ প্রায় ভোরে তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে রাষ্ট্রপতির ধানমণ্ডিস্থ বাসভবন ঘিরে ফেলে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের হত্যা করে। কেবল তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করার কারণে বেঁচে যান।

অবশেষে, বাঙ্গালি জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলার প্রথম অধ্যায়ের সূচনা হয়। শুরু হয় সামরিক শাসনের যুগ। কেড়ে নেওয়া হয় গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার।

২৩শে জুন ১৭৫৭ সালের মতই ঘাতদের দ্বারা আক্রান্ত হয় বাংলাদেশ। পিতাকে হত্যা করার মত পাপের পর এখনো পর্যন্ত কলঙ্ক মুছতে পারেনি বাংলার বারিধারা। এখন শুধু প্রয়োজন অপেক্ষা, ততদিন পর্যন্ত যতক্ষণ না সেই ঘাতকদের যুগ শেষ হচ্ছে। ঘাতক পর্যায়ের একজন বেঁচে থাকতেও বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া সম্ভব না।

তথ্যসূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনীশেখ মুজিবুর রহমান

Comments

    Report

    Please Select a problem
    If someone is in immediate danger, get help before reporting to us. Don't wait.